ভ্যাকসিনে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে যেসব রোগ করোনাভাইরাস শনাক্তের পর থেকে দেশে দেশে এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারে চলছে ব্যাপক গবেষণা। ভ্যাকসিন বা টিকার মাধ্যমে যেকোনো রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় মানব শরীরে। এজন্য যেকোনো সংক্রামক রোগের আক্রমণ থেকে বাঁচতে টিকা বা ভ্যাকসিনের গুরুত্ব অপরিসীম।
কিন্তু গেল দুই শতাব্দীতে পৃথিবী থেকে টিকার মাধ্যমে কতগুলো রোগ নির্মূল হয়েছে? এর উত্তর খুব বেশি নয় – মাত্র দু’টি। এর একটি হলো স্মল পক্স, বাংলায় যাকে গুটি বসন্ত বলা হয়। আর অন্যটি রাইন্ডারপেস্ট নামে একটি ব্যাধি, যা মূলত গবাদি পশুর একটি রোগ।
এই মুহূর্তে অন্তত কয়েক ডজন রোগের টিকা চালু আছে পৃথিবীতে। ভিন্ন ভিন্ন রোগ প্রতিরোধে দেয়া হচ্ছে এসব ভ্যাকসিন। কিন্তু এসব রোগ নির্মূল করা সম্ভব হয়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, টিকা দেয়ার কারণে প্রতি বছর বিশ্বে ২০ থেকে ৩০ লক্ষ শিশুর প্রাণরক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে।
বাংলাদেশে সরকারের মহামারি ও সংক্রামক ব্যাধি সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান তাহমিনা শিরিন বলেন, সংক্রামক ব্যাধি ঠেকানোর জন্য ভ্যাকসিন বা টিকা অত্যাবশ্যক।
তিনি বলেন, টিকা শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরির মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তাহমিনা শিরিন আরও বলেন, ভ্যাকসিন একটি জীবাণুকে নিষ্ক্রিয় করার মাধ্যমে মানব শরীরে সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় করতে সহায়তা করে। যদি বাংলাদেশের ইপিআই বা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির দিকে তাকান, তাহলে দেখবেন ইনফেকশনের কারণে দেশে শিশু মৃত্যুর হার অনেক হ্রাস পেয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ছয়টি মহাদেশীয় অঞ্চলের মধ্যে অন্তত চারটিতে যদি কোনো রোগে এক দশক সময়ের মধ্যে কেউ আক্রান্ত না হন, তাহলে ধরে নেয়া হয় সেই রোগটি দূর হয়েছে।
হামের কথা ধরা যাক- পৃথিবীর বেশির ভাগ অংশে এখন আর মানুষের হাম হয় না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত হামের টিকা ব্যবহারে এ রোগে মৃত্যুর হার প্রায় ৮০ শতাংশ কমে এসেছে।
বাংলাদেশে মা ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচির সাবেক প্রধান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দেশে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের সরকার যে বিনামূল্যে টিকা দেয়, তার মাধ্যমে ডিপথেরিয়া, হামসহ বেশ কয়েকটি রোগ দূর করা সম্ভব হয়েছে। পোলিও রোগও প্রায় নির্মূল হওয়ার পথে, বলতে গেলে দেশে এখন প্রায় শোনাই যায় না।
সরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশে ১০টি টিকা বিনামূল্যে দেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে নিউমোনিয়া, পোলিও, মাম্পস, নিউমোকক্কাল, হেপাটাইটিসের মতো বেশ কয়েকটি টিকা। এর ফলে নিশ্চিতভাবেই সংক্রমণজনিত রোগে শিশু এবং মাতৃ মৃত্যু অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীর আলম।
গুটি বসন্ত
গুটি বসন্ত বহু প্রাচীন একটি রোগ। গুটি বসন্তের টিকার আবিষ্কারক ব্রিটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার ১৭৯৮ সালে এ টিকা উদ্ভাবনের স্বীকৃতি পান।
এই রোগ যাদের হত তাদের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগই মারা যেতেন। আর যারা বেঁচে থাকতেন, তারা হয় অন্ধ হয়ে যেতেন, কিংবা তাদের মুখে-শরীরে থাকতো মারাত্মক ক্ষতচিহ্ন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৭৯ সালের ৯ই ডিসেম্বর বিশ্বকে গুটি বসন্ত মুক্ত বলে ঘোষণা করে। তবে এ সংক্রান্ত একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয় ১৯৮০ সালের মে মাসে।
বাংলাদেশ থেকে গুটি বসন্তের বিদায়
বাংলাদেশের ভাইরোলজিস্টরা জানিয়েছেন, এ অঞ্চলে গুটি বসন্তের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারি হয়েছিল ১৯৫৮ সালে- সে সময় মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে প্রায় ৫৯ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন।
বাংলাদেশে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচির সাবেক প্রধান জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, ১৯৬১ সালে এই অঞ্চলে গুটি বসন্তের টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। এরপর ক্রমে গুটিবসন্তের মৃত্যুহার কমতে থাকে। এর পরের ১০ বছরে মৃত্যুর হার অনেকগুণ কমে আসে। তবে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে গুটি বসন্ত আবার ফিরে আসে।
সে সময়কার মৃত্যুর সংখ্যা সম্পর্কে নির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া না গেলেও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গুটি বসন্ত সে সময় দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে ছড়ায়নি। তবে ১৯৭৪ সালের পর বাংলাদেশে আর গুটি বসন্ত দেখা যায়নি।
রাইন্ডারপেস্ট
১৮৯৭ সালে প্রথম গবাদিপশুর বসন্ত রাইন্ডারপেস্ট ভাইরাসের টিকা আবিষ্কার হয়। পরে এ রোগের আরও কার্যকর টিকা আবিষ্কার হয় ১৯৫০-এর দশকে ওয়াল্টার প্লাওরাইট নামে একজন বিজ্ঞানী এর উদ্ভাবন করেন।
২০১০ সালের ১৪ অক্টোবর পৃথিবী থেকে গবাদিপশুর বসন্ত রাইন্ডারপেস্ট নির্মূল হয়েছে বলে ঘোষণা করে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা বা এফএও।
এর আগের এক দশকে এই রোগ আর দেখা যায়নি বলে এ ঘোষণা দেয়া হয়।